বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা (বিপিইউএস) এর উদ্দ্যোগে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে প্রতিবন্ধী নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও ন্যয়বিচার প্রাপ্তির অধিকার বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠীত হয়। উক্ত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব শেখ আবু তাহের, বিজ্ঞ বিচারক (জেলা জজ), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় স্পেশাল জজ জনাব দিলীপ কুমার ভৌমিক সহ চৌদ্দ জন বিচারিক কর্মকর্তা। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এ্যাড. ফয়জুল হক ফয়েজ, স্পেশাল পিপি- নারী ও শিশু নির্য়াতন দমন ট্রাইব্যুনাল, এ্যাড. নাসির উদ্দীন খাঁন, অতিরিক্ত পিপি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এর বরিশাল ইউনিটের সমন্বয়কারি এ্যাড. খলিলুর রহমান, এ্যাড মনিরা বেগম, বিভাগীয় প্রধান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি সহ বিজ্ঞ আইনজীবী বৃন্দ, এনজিও প্রতিনিধি, শিক্ষক সহ ৭৫ অংশগ্রহনকারি।
সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও অধিকার কর্মি জনাব রেজাউল করিম সিদ্দিকী। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন্নাহার মিস্টি। উক্ত সেমিনারটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী উন্নয়ন স্ংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও ন্যাডপো’র মহাসচিব জনাব বদিউল আলম।
উক্ত সেমিনারে প্রতিবন্ধী নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রচলিত আইন সমূহের বিশেষত: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর প্রয়োগ, কার্যকারিতা ও বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বিশদ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সম্মানীত আলোচকবৃন্দ নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে উক্ত আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও ন্যয়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের করনীয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও সুপারিশ প্রদান করেন। বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল জজ জনাব শেখ আবু তাহের বলেন প্রতিবন্ধী নারীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে প্রতিবন্ধী ভিকটিমের সহায়ক হিসেবে কাজ করার জন্য প্রতিবন্ধী সংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশ, বিচারক, পিপি ও আইনজীবী সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি “ট্রায়াল প্যানেল” গঠণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কারের বিষয়ে তিনি উদ্দ্যোগ গ্রহন করার পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি বলেন সাক্ষ্য আইন সংস্কারের জন্য আইন কমিশনের নিকট একটি সুপারিশ প্রদান করা যেতে পারে। তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৪ ধারার সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী বাদি ও সাক্ষীদের ব্যয়ভার বহনের উদ্দ্যোগ নেয়ার পরামর্শ প্রদান করেন। বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় স্পেশাল জজ জনাব দিলীপ কুমার ভৌমিক বলেন, প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এবং যেকোন ব্যক্তি যেকোন সময়ে প্রতিবন্ধিতার শিকার হতে পারেন। সুতরাং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের বিষয়ে সকলকে সংবেদনশীল হবার আহবান জানান। আইনজীবীবৃন্দ প্রতিবন্ধী ক্লায়েন্টদের মামলা পরিচালনায় অধিকতর সংবেদনশীল হবার পরামর্শ প্রদান করেন। তারা বলেন প্রতিবন্ধিতাকে অধিকারের বিষয় হিসেবে দেখতে হবে, এটি দয়া বা অনুগ্রহের বিষয় নয়। অনুষ্ঠাণের সঞ্চলক আশরাফুন্নাহার মিস্টি বলেন আইনজীবীগন প্রতিবন্ধী ভিকটিমদের মামলা সমূহে সমঝোতাকে উৎসাহিত করেন। ফলে নির্যাতনকাররিদের সাজা হয় না, যা সহিংসতাকে খানিকটা উস্কে দিচ্ছে। এ ব্যপারে তিনি বিজ্ঞ বিচারক মহোদয়কে ভূমিকা রাখার আহবান জানান। সেমিনারের সভাপতি বলেন, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী আনুকূল্য প্রত্যাশী নয়, দক্ষতা দিয়েই তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চান। কিন্তু পারিপাশির্^ক প্রতিবন্ধকতার কারনে প্রত্যাশিত মাত্রায় সাফল্য আসছে না। তিনি সকলকে সহযোগিতা প্রদানের অনুরোধ করেন। প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতি সংহিংসতা প্রতিরোধ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিচারক মহোদয়ের উপস্থিতিতে অদ্যকার সেমিনার বরিশালে প্রথমবারের মত আয়োজিত হল। ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্মসূচী আয়োজনের ব্যপারে সহযোগিতা অব্যহত রাখার আহবান জানিয়ে তিনি সকল বিচারক মহোদয়কে আআন্তরীক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
সেমিনারে প্রস্তাবিত সুপারিশ সমূহ হলঃ
১. প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণের ইন্দ্রিগত প্রতিবন্ধকতা বিবেচনা করে আইনের প্রচার-কৌশল নির্ধারণ। যেমন: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীগণের সুবিধার লক্ষ্যে অডিও নির্ভর ও ভিজ্যুয়ালবিহীন প্রচারনা। ওয়েবসাইটে লিখিত ডকুমেন্টের পাশাপাশি অডিও ভার্সন সংরক্ষণ। একইভাবে, শ্রবণ প্রতিবন্ধীগণের সুবিধার্থে অডিওবিহীন কেবল ভিজ্যুয়াল বা চিত্রনির্ভর প্রচারনা ইত্যাদি। এভাবে অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুবিধার্থে পদক্ষেপ গ্রহন করা।
২. বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের সকল মামলা আইনগত সহায়তার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে ডিল্যাক-এ প্রেরণ/ভিকটিমকে পরামর্শ প্রদান। উল্লেখ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগন আইনী সহায়তার বিষয়ে অজ্ঞতাবশত: নিজে থেকে আইনগত সহায়তার আবেদন করেন না। আমাদের অভীজ্ঞতা অনুযায়ী ডিল্যাক এর মামলা অপেক্ষাকৃত দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং মামলার মাঝপথে ড্রপ-আউটের পরিমান কম। আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করা হলে মামলার ইতিবাচক ফলাফল নিশ্চিত হবে বলে আমরা বিশ^াস করি।
৩. বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, বার কাউন্সিল সহ বিচারক, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ন্যস্ত প্রতিষ্ঠাণ সমূহের পাঠ্য-সূচীতে প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে ধারনা ও ডিজএ্যাবিলিটি সেনসিটিভ দক্ষতাবৃদ্ধির পাঠ-উপকরণ সংযুক্ত করা।
৪. স্থানীয় বার এ্যাসোসিয়েসনের মাধ্যমে আইনজীবীবৃন্দকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার বিষয়ে সেনসিটাইজ/সংবেদনশীল করা।
৫. প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-সংগঠণ (ডিপিও) সমূহের সক্ষমতাবৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ন।
৬. ডিল্যাক, উজল্যাক, ইউল্যাক ও বিশেষ কমিটি (চৌকি আদালতের জন্য) সমূহে ডিপিও ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্তি। কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব না হলেও অন্তত:পক্ষে পর্যবেক্ষক হিসেবে কমিটি সমূহের সভায় উপস্থিত থাকার অনুমতি প্রদান।
আইনী সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ সমূহঃ
৭. যে সকল মামলায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট রয়েছেন সে সকল মামলায় পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী সমন্বয়ে একটি বিচার সমন্বয় প্যানেল গঠণ করা। সংশ্লিষ্ট বিচারক যাতে এরূপ প্যানেল গঠণ করতে পারেন সে সুযোগ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় আইনী সংস্কার করা।
৮. আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ও বিধিমালা সংশোধনের মাধ্যমে ভিকটিমের থাকা, খাওয়া ও যাতায়াতের খরচ প্রদানের বিধান সংযোজন করা।
৯. সাক্ষ্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে ইল্কেট্রনিক সাক্ষ্যেকে প্রাথমিক ডকুমেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান।
১০. দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, ডেফ-ব্লাইন্ড প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রমানের দায় আসামীপক্ষের উপর স্থানান্তর করা।